হুযুর পাক (আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম) উনার পবিত্র বক্ষ বিদারণের রহস্য

আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- الم نشرح لك صدرك অর্থাৎ আমি কি আপনার বক্ষকে প্রশস্ত করে দেইনি ? (সূরা ইনশিরাহ, আয়াত-১)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় খাযাইনুল ইরফানে বলা হয়েছে- “আমি আপনার বক্ষস্থলকে প্রশস্ত ও বিস্তৃত করেছি- হিদায়াত, মারেফাত, উপদেশ, নবুওয়্যাত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য এমনকি দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতই প্রশস্ততার মধ্যে সংকুলান হয়ে গেছে। আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ আত্মিক আলোক বিকীরণের জন্য অন্তরায় হতে পারেনি এবং খোদা প্রদত্ত জ্ঞান, আল্লাহর হিকমতসমূহ, প্রতিপালকের পরিচয় এবং পরম করুণাময়ের হাক্বীক্বতসমূহ পবিত্র বক্ষে বিকশিত হয়েছে।”

আর প্রকাশ্য ‘শরহে সদর’ (বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ)ও বার বার হয়েছে- বাল্যকালে, ওহী নাযিল হবার প্রাথমিক যুগে এবং মিরাজ রাত্রে। যেমন হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে  “তা (বক্ষ সম্প্রসারণ) এভাবে হয়েছিল যে, জিব্রাঈল আমীন (আলাইহিস্ সালাম) পবিত্র বক্ষকে বিদীর্ণ করে ‘ক্বলব’ (হৃদয়) মোবারক বের করেছিলেন এবং তা স্বর্ণের পাত্রের মধ্যে রেখে যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করেন। আর নূর ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ করে তা যথাস্থানে রেখে দিয়েছেন।”

অতএব, প্রকাশ্য বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ হয়েছে তা প্রমাণিত হল এবং হাদীস শরীফেও তা সুস্পষ্ট রয়েছে। আর সাথে হুজুর করিম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সুস্পষ্ট একটি  মো‘যেজাও বিকশিত হল এবং তাও প্রমাণিত হল যে, তিনি আমাদের মত মানুষ নয়। কেননা, তাঁর পবিত্র বক্ষকে বিদীর্ণ করা হল কিন্তু তিনি সামান্য অসুস্থ হলেন না, বিন্দু পরিমাণ রক্তও ঝরল না। অথচ তাঁর প্রকৃত সত্ত্বা মানুষ হলে রক্ত ঝরা অবশ্যম্ভাবী ছিল।

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর বক্ষ মোবারক থেকে নাভী মোবারক পর্যন্ত কাটল জোড়া লাগার এক পাতলা রেখা আমরা দেখতে পেতাম। (যিকরে হাসীন)

আর তা এজন্যই যে, কেউ যেন বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করতে না পারে।

মুহাদ্দীসীনে কেরামগণ বলেন  হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর বক্ষ বিদারণ চারবার হয়েছে। যথা 

১. যখন তাঁর পবিত্র বয়স ৩ বছর, মা হালিমা সাদীয়ার নিকট ছিলেন তখন।
২. দশ বছর বয়সে।
৩. ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় হেরা গুহায়।
৪. মিরাজ রাত্রিতে ভ্রমণের পূর্বে।

ঘটনা হল, হুজুরপাকের বক্ষ বিদারণের জন্য বেহেশত হতে স্বর্ণের থালা নিয়ে জিব্রাঈল আমীন আলাইহিস্ সালাম অন্যান্য ফেরেশতাদেরসহ আসলেন। অতঃপর তাঁকে অত্যন্ত আদরের সহিত শুয়ায়ে দিলেন। অনন্তর তাঁর পবিত্র পেট বিদীর্ণ করলেন। পরে তা হতে পবিত্র নাড়িভূঁড়ি, হৃৎপিন্ড, প্লীহা ইত্যাদি বের করে তা যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করলেন। অতঃপর তা যথাস্থানে রেখে দিলেন। তারপর সেখান থেকে একটি গোশতের টুকরা বের করে ফেলে দিলেন এবং বললেন, এটা শয়তানের অংশ। তারপর নূরানী মোহর দ্বারা অন্তর মোবারকে মোহরাংকিত করা হল এবং বক্ষ থেকে নাভী পর্যন্ত হাত বুলিয়ে দেয়া হল। তখন ওই ফাটল মিলে যায়।

এখন কথা হল, গোশত পিন্ডকে শয়তানের অংশ বলার অর্থ কী ? এবং যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করার অর্থই বা কী ? এর দ্বারা কী নবীজীকে দোষারূপ করা হয় না ? এবং বক্ষ বিদারণের পূর্বে তাঁর মধ্যে শয়তানী প্রভাব ছিল বা পাপময় ছিল তাঁর পবিত্র চরিত্র তা প্রমাণ হয় না ? (নাউযুবিল্লাহি মিন হাকা যালিক)।

আসলে, প্রকৃত ব্যাপার হল অজ্ঞতা, অন্তরে রাসূল প্রেম না থাকা এবং আল্লাহর পক্ষ হতে সাহায্যের অভাবেই কেউ এমনটি বলতে পারে। এ বিষয়ে অবগত না হয়ে এ বিষয়ে এমনটি সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে না যে, হুজুর পাকের মধ্যে কলুষতা ছিল (নাউযুবিল্লাহ ছুম্মা নাউযুবিল্লাহ)। আবার এর দ্বারা এও বলা যাবে না যে, হুজুর পাকের বক্ষ বিদারণই হয় নাই। তাহলে তাঁর একটি মোজেযাকে অস্বীকার করা হবে। এর প্রকৃত ব্যাখ্যা জানা দরকার।

শরহে সদর বা বক্ষ বিদারণের রহস্য

ক্বলব মোবারককে বিদীর্ণ করার মধ্যে ব্যাপক রহস্য রয়েছে। যা চক্ষুষ্মানদের নিকট সুস্পষ্ট। আর যাদের অন্তরে পাপময় কালিমা রয়েছে যাদের জন্য আল্লাহর গজব নির্ধারিত তারাই শুধুমাত্র এর অপব্যাখ্যা করতে পারে।

ক্বলব মোবারক ধৌতকরণের রহস্যঃ

ক্বলব মোবারককে যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করা কোন মলিনতার কারণে ছিল না। কেননা বিশ্বকুল সরদার হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হলেন পূতঃপবিত্রদের সর্দার। এমনকি গোটা সৃষ্টিকে পবিত্রকারী। তিনি এমন পুতপবিত্র যে, মা আমেনার (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা) কোলে যখন আসলেন সেই জাহেরী জন্মলগ্নেও তাঁকে গোসল দেয়া হয়নি। অতএব, ক্বলব মোবারক যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করা কেবল এ রহস্যের ভিত্তিতেই ছিল যে, এ দ্বারা যমযমের পানিকে সেই মর্যাদা দান করা হবে, যা পৃথিবীর কোন পানিতে নেই। এমনকি হুজুরের সাথে স্পর্শের বরকতে জান্নাতের ফোয়ারা কাউসার ও তাসনীমের মধ্যেও সে ফযীলত নেই যা যমযমের পানিতে দেয়া হয়েছে।

মিরাজের রাত্রে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর বক্ষ মোবারক বিদারণে অসংখ্য রহস্য নিহিত, যার মধ্যে একটি রহস্য এও রয়েছে যে, ক্বলব মোবারকে যেন এইরূপ কুদসী শক্তি (আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ রূহানী শক্তি) সক্রিয় হয়ে যায় যা দ্বারা আকাশমন্ডলীতে গমন করা এবং ঊর্ধ্ব জগত প্রত্যক্ষ করা বিশেষতঃ আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য হওয়ার পথে কোন দুষ্করতা ও জটিলতার সম্মুখীন হতে না হয়।

রক্ত বা গোশত পিন্ডকে শয়তানের অংশ বলার অর্থঃ

আল্লামা তক্বীউদ্দীন সুবকী (রহমাতুল্লাহে আলাইহে) বলেছেন, আল্লাহপাক প্রত্যেক মানুষের অন্তরে এ রক্ত বা গোশত পিন্ড সৃষ্টি করেছেন। তার কাজ হল এই যে, মানুষের অন্তরে শয়তান যা কিছু পৌঁছায় তা গ্রহণ করা।আর হুজুর পাকের বক্ষ মোবারক থেকে যা অপসারণ করা হয়েছে, তা হল হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র সত্ত্বায় এমন কিছু বাকী থাকেনি যা শয়তানী কুমন্ত্রণাকে গ্রহণ করবে। আল্লামা তক্বীউদ্দীন বলেন, এই হাদীস দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র সত্ত্বায় শয়তানের কোন অংশ কখনই ছিল না। অর্থাৎ তা মানবাকৃতিতে আবির্ভাবের পূর্বে তো কল্পনাই করা যায় না, এমনকি মানবরূপে মানবীয় গুণাবলীর সমন্বয়ে আসার পরেও ঐ পবিত্র সত্ত্বায় শয়তানের কোন অংশ ছিল না।

প্রশ্ন বাকী থেকে যায় যে, যদি এই ছিল ব্যাপার, তবে আল্লাহপাক হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র সত্ত্বায় ঐ রক্তপিন্ড কেন সৃষ্টি করলেন ? প্রথমেই পবিত্র সত্ত্বায় তা সৃষ্টি না করলেও পারতেন। তার উত্তরে বলা হবে ওটা সৃষ্টি করার পেছনে রহস্য এই রয়েছে যে, তা মানবীয় অঙ্গসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তা সৃষ্টি করা মানবীয় সৃজন প্রক্রিয়ার পূর্ণতার জন্য আবশ্যক এবং তা অপসারণ করা অন্য ব্যাপার যা সৃষ্টির পর সম্পাদিত হয়েছে।

মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহে আলাইহে বলেন, এর উপমা যেন মানবদেহে অতিরিক্ত বস্তুসমূহের সৃজন। যেমন লিঙ্গের মাথায় চর্ম হওয়া (যা খৎনার সময় অপসারণ করা হয়), নখ, গোঁফের বৃদ্ধি এবং এভাবে অপরাপর বস্তুসমূহ। সংক্ষিপ্ত সার হল, এই অতিরিক্ত বস্তুসমূহের সৃজন মানবদেহের অঙ্গসমূহের পূর্ণাঙ্গতা এবং এগুলোর অপসারণ পরিপূর্ণ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার দাবী। (শরহে শিফা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৭৪)

হুজুর পাকের পবিত্র জাত বা সত্ত্বাতো মূলতঃ নূর। আর মানবাকৃতিতে প্রকাশ হওয়াটা তিনির সিফাত বা গুণ। অর্থাৎ তিনির সত্ত্বা নূর হয়েও অসংখ্য আকৃতি ধারণের ক্ষমতা তাঁকে দেয়া হয়েছে আল্লাহর পক্ষ হতে আর এ অংশটি হল মানবাকৃতির পূর্ণতার জন্যই। আর না হয় তাঁকে অপূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতি বিশিষ্ট বলতে হত। অথচ যাবতীয় কামালিয়াতের (পূর্ণতার) আঁধার হলেন তিনি। আর পরবর্তীতে তা অপসারণ করা হল, যেন শরীরে বাড়তি নখ বা লোমগুলোকে ফেলে দেয়া হয়।

সাথে কিছুসংখ্যক ঐ সমস্ত অন্ধজনের বক্তব্য খন্ডন করা যারা বলে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম থেকে ভুল-ত্র“টি প্রকাশ পেতে পারে। মূলতঃ হুজুর পাকের মধ্যে শয়তানী কোন অংশই কখনো ছিল না। তা নবীজী নিজে ফরমান   “আমার হামযাদ মুসলমান হয়ে গেছে। সুতরাং সে আমাকে ভাল কথাই বলে।”

আর হামযাদ হল  সেই শয়তান যা প্রত্যেক মানবের সঙ্গে সৃষ্টি হয় এবং সর্বদা সঙ্গে থাকে।

হায়াতুন্নবীর দলিলঃ

এছাড়াও এ বক্ষ বিদারণের দ্বারা হুজুর পাকের হায়াতুন্নবী হওয়ার বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়ে যায়, সাথে নবীজী যে, মূলতঃ  মানুষ নয় তাহাও। অর্থাৎ, অন্যান্য সকল মানুষের রূহ আলাদা হলে তারা মৃত্যুবরণ করে এবং অনুভূতি শূন্য হয়ে যায়। অথচ হুজুর পাক থেকে বক্ষ বিদারণের সময় রূহ আলাদা করা হয়েছে বটে কিন্তু তথাপিও তাঁর ইন্তেকাল হয়নি এবং তিনি অনুভূতিহীনও হননি। (সুবহানাল্লাহ)

এছাড়াও আরও বহু ফাযায়েল ও রহস্য রয়েছে পবিত্র বক্ষ বিদারণে। আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন। রাসূলে পাকের মর্যাদা অনুধাবনের তৌফিক দিন। আমিন!

Courtesy: Razvia.com

Comments