বস্তুবাদ কী? পবিত্র কালেমায় বিশ্বাসী কেউ কি বস্তুবাদী হতে পারে?
♣ বস্তুবাদ কী???
দর্শনের সবচেয়ে প্রাথমিক মতবাদগুলোর একটি হল বস্তুবাদ। আমাদের চারপাশের জগতের যেসব অস্তিত্ত্ব আমরা পর্যবেক্ষণ করি বস্তুবাদ অনুযায়ী তারা যেকোন প্রকার চেতনা নিরপেক্ষ। যে দার্শনিক ধারায় ধরে নেওয়া হয় যে পৃথিবী বস্তুগত, তার অস্তিত্ব আছে বিষয়গতভাবে, চৈতন্যের বাইরে ও চৈতন্য-নিরপেক্ষভাবে, বস্তুই মুখ্য, তা কারো দ্বারা সৃষ্টি হয়নি এবং আছে বাহ্যিকভাবে, চৈতন্য, চিন্তন হল বস্তুরই একটি গুণধর্ম; পৃথিবী ও তার নিয়মগুলি জ্ঞেয়। বস্তুবাদ ভাববাদের বিরোধী এবং তাদের সংগ্রামই ঐতিহাসিক-দার্শনিক প্রক্রিয়ার আধেয়। বস্তুবাদ কথাটি ১৭শ শতাব্দীতে ব্যবহৃত হয়েছিল প্রধানত বস্তু সম্বন্ধে পদার্থবিদ্যাগত ধারণাগুলির অর্থে এবং ১৮শ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে তা ব্যবহৃত হয়েছে দার্শনিক অর্থে, ভাববাদের বৈপরীত্যে।
♣ নোট ১ // বস্তুবাদীরা মনে করে যে বস্তুই মূখ্য।
♣ নোট ২// বস্তু কারো দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তা বলতে কিছুই নেই।
♣ নোট ৩// মাত্র ২০০ বছর আগে বস্তুবাদ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে।
দর্শন প্রাথমিকভাবে দু’টি বৃহৎ শিবিরে বিভক্ত; ভাববাদ এবং বস্ত্তবাদ। লেনিন লিখেছেন, “ মার্ক্সবাদের দর্শন হ’ল বস্ত্তবাদ”।
দার্শনিক বস্তুবাদ সেই দৃষ্টিভঙ্গি যা দিয়ে কেবলমাত্র বস্ত্ত-জগতের কথাই স্বীকার ও ব্যাখ্যা করা হয়। এখানে বস্তু ভিন্ন অন্য কোন পারজাগতিক অস্তিত্ব বস্তুবাদ স্বীকার করে না। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে স্বর্গ ও নরকের কোন স্বীকৃতি থাকে না। বিশ্বজগৎ সর্বদা-অস্তিত্বশীল একটি বিষয় এবং তা কোন অতি-প্রাকৃতিক সত্ত্বার সৃষ্ট নয়। এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্যে গতিশীল এক বাস্তবতা।বস্তুবাদ অনুসারে, মানুষ হল প্রকৃতির একটি অংশ এবং নিম্নশ্রেণির জীব থেকে তা বিবর্তিত হয়েছে; যার মূল উৎস ৩.৬ বিলিয়ন বা কাছাকাছি বছর পূর্বে প্রাণহীন বস্ত্তজগৎ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। প্রাণের বিবর্তনের বিশেষ এক পর্যায়ে প্রাণিদের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের উন্মেষ ঘটে এবং ঘটনাচক্রে বৃহৎ-মস্তিস্ক-সম্পন্ন (অপেক্ষাকৃত বেশী ঘণত্ব সম্পন্ন) মানুষ প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। মানুষের বিবর্তনের সাথে সাথে মানবচিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটে। কেবলমাত্র মানুষের মস্তিস্কের পক্ষেই উন্নত সাধারণ ধারনা সৃষ্টির তথা চেতনা অর্জনের সক্ষমতা আছে। অতএব বস্তু যা চিরকাল কোন না কোন রূপে অস্তিত্বশীল ছিল এবং এখনো তা মানুষ ও জীবজগতের চেতনা-স্বতন্ত্র বা নিররেপক্ষভাবে অস্তিত্বশীল আছে। বস্তু তার সম্পর্কে সচেতনতার উন্মেষের বহুপূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল ছিল, চেতনা বিলুপ্ত হবার পরেও তা থাকবে। এমনকি প্রাণির (মানুষরূপী) মধ্যে চেতন-ক্ষমতার উন্মেষের পূর্বেও বস্ত্তর অস্তিত্ব বর্তমান ছিল।
♣ নোট ৪// বস্তুবাদীরা পরকাল এবং স্বর্গ-নরক (জান্নাত-জাহান্নাম) এ বিশ্বাসী নয়।
♣ নোট ৫// বিশ্বজগৎ অস্বীত্বশীল অর্থাৎ বিশ্বজগৎ অনাদি অনন্ত এবং তা কোন স্বত্তার (আল্লাহ'র) সৃষ্ট নয়।
♣ নোট ৬// মানুষ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৩.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে প্রানহীন জড়বস্তু থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
বস্তুবাদীদের মতে, জীবিত-মস্তিস্ক থেকে বিছিন্ন চেতনার কোন অস্তিত্ব নেই, আর মস্তিস্ক নিজেই বস্তুগত দেহের একটি অংশ মাত্র। দেহ ছাড়া মনের অস্তিত্ব একটি অসম্ভব বা অর্থহীন ধারণা মাত্র। বস্তু মন বা চেতনা থেকে তৈরী নয় বা উপজাত নয় বরং চেতনা হ’ল বস্ত্তর সর্বোচ্চ উৎপাদ বা উপজাত বিষয়। ধারণাসমূহ আমাদের চারপাশের স্বাধীন (চেতনা-নিরপেক্ষ) বস্ত্ত-জগতের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়। দর্পনে প্রতিফলিত বস্ত্ত তার অস্তিত্বের জন্য প্রতিফলিত প্রতিবিম্বের উপর নির্ভর করে না। এঙ্গেলসের ভাষায় “ সকল ধারণা অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া, যা বাস্তবতার সঠিক অথবা বিকৃত প্রতিফলন মাত্র।” অথবা মার্ক্সের ভাষায় বলা যায়, “ জীবন চেতনা দিয়ে নির্ধারিত হয় না বরং চেতনাই জীবন দ্বারা নির্ধারিত হয়।”
♣ বস্তুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গির এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীন গ্রিসের এনাক্সোগোরাস (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ -৪২৮ অব্দ) এবং ডেমোক্রিটাস ( খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ – ৩৭০ অব্দ) বস্তুবাদী ধারণা পোষণ করতেন। প্রাচীন ভারতে চার্বাকও (খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম অথবা অস্টম শতাব্দি) বস্তুবাদী দার্শনিক। ভারতীয় দর্শনের বিকাশের সমগ্র কাল জুড়ে আধ্যাত্মিক দর্শনের সমান্তরালে বস্তুবাদী দর্শনের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু, সমাজ বিকাশের নানা ঘনঘটায় তা পূর্ণতা পেতে পারেনি। তেমনি প্রাচীন গ্রিসের পতনের পর, এই যৌক্তিক বস্তুবাদী দৃস্টিভঙ্গি একটি বিরাট ঐতিহাসিক কালপর্ব জুড়ে বিস্মৃতপ্রায় হয়ে যায়। খ্রিস্টীয় মধ্যযুগের পতনের পথধরে চিন্তার নবজাগরণের মধ্যদিয়ে দর্শন এবং প্রকৃতি-বিজ্ঞানের পুণর্জন্ম হওয়ার পরই কেবল এ দৃস্টিভঙ্গি’র পুন: আবির্ভাব ঘটে। সপ্তদশ শতক থেকে ইংল্যান্ড হয়ে ওঠে আধুনিক বস্তুবাদের নিজস্ব-ভূমি। মার্ক্স লিখেছেন, “ ইংরেজ বস্তুবাদের যথার্থ আদি-পুরুষ হলেন বেকন।” ফ্রান্সিস বেকনের (১৫৬১ – ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দ)বস্তুবাদ থমাস হবসের( ১৫৮৮ – ১৬৭৯) হাতে সুশৃঙ্খল ও আরো বিকশিত হয়। হবসের ধারনাসমুহ জন লকের ( ১৬৩২ – ১৭০৪)হাতে আরো বিকাশ লাভ করে। শেষোক্তজন ভাবতে পেরেছিলেন যে,বস্তর পক্ষে চিন্তার ক্ষমতাকে ধারন করা সম্ভব। বুর্জোয়া বিকাশ ও বিজ্ঞানের মহৎ অগ্রগতি বিশেষত বলবিদ্যা, যন্ত্রকৌশলবিদ্যা, জোতির্বিজ্ঞান ও ঔষধবিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে মানবচিন্তার উপর্যুক্ত অগ্রগতির সমগামীতা কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এই চিন্তকদের ধারাবাহকতায় অষ্টাদশ শতাব্দির ফরাসি বস্তুবাদী দার্শনিক সম্প্রদায় এক্ষেত্রে এক ব্যাপক-সাফল্য অর্জন করে, যাদের মধ্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রেনে দেকার্তে ( ১৫৯৬ – ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ)।
এ বস্তুবাদী দর্শন তার ধারাবাহিকতায় হলবাখ ( ১৭২৩ -১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দ) ও হেলভেটিয়াসের হাতে এক বিপ্লবী দর্শনে উন্নীত হয়। হলবাখ লিখেছেন “ বিশ্বব্রহ্মান্ড হলো সকল কিছুর (সকল পদার্থের) এক ব্যাপক ঐক্য। কাজেই,সর্বক্ষেত্রে এটি আমাদের কেবল গতির মধ্যেকার বস্তু বা গতিশীল বস্তুরই মুখোমুখি করে।”
এদের এই বস্তুবাদী ও যুক্তিবাদী চিন্তা ১৭৮৯ সালের মহান ফরাসি বিপ্লবের মর্মবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। এ সকল বস্তুবাদী চিন্তকরা জগতবহির্ভূত বা বাহ্যিক-জগতাতিরিক্ত কোনপ্রকার কর্তৃত্ব স্বীকার করতেন না। ধর্ম থেকে প্রকৃতি-বিজ্ঞান, সমাজ থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান – এককথায় সকলকিছুকেই এরা অনুসন্ধানি সমালোচনার বিষয়ে পরিনত করেছিলেন।
সুতরাং, আপনাদের নিকট আমি প্রশ্ন রাখতে চাই,
১) কালেমায় বিশ্বাসী কেউ কি এটা মনে করে, এই বিশ্বজগৎ এবং যা কিছু আছে তা মহান আল্লাহ পাকের সৃষ্টি নয় (!) অথচ বস্তুবাদীরা মনে করে সবকিছু বস্তুর বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে।
২) পবিত্র কালেমায় বিশ্বাসী কেউ কি মনে করে, বস্তুর বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফলে সকল সৃষ্টির উদ্ভব হয়েছে? অথচ বস্তুবাদীরা এটা মনে প্রানে বিশ্বাস করে।
৩) পবিত্র কালেমায় বিশ্বাসী কেউ কি পারজাগতিক সময় অর্থাৎ জান্নাত এবং জাহান্নাম কে অস্বীকার করে? অথচ বস্তুবাদীরা স্বর্গ-নরকের অস্তীত্ব অস্বীকার করে।
৪) পবিত্র কালেমায় বিশ্বাসী কেউ কি বস্তুকে অনাদি অনন্ত বলে মনে করে? অথচ বস্তুবাদীরা বস্তুকে অনাদী এবং অনন্ত মনে করে। অর্থাৎ, তাদের মতে বস্তু এক রূপ থেকে অন্যরূপে পরিবর্তিত হয়,কিন্তু ধ্বংস হয় না।
৫) পবিত্র কালেমায় বিশ্বাসী কেউ কি মহান আল্লাহর অস্তীত্ব অস্বীকার করে? অথচ বস্তুবাদীরা সৃষ্টি কর্তাকে অস্বীকার করে।
উক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হল যে বস্তুবাদই হল নাস্তিক্যবাদ।বস্তুবাদী মনোভাব তারাই পোষণ করতে পারে যারা মহান আল্লাহ এবং তাঁর সৃষ্টিকে অস্বীকার করে,পরকাল অস্বীকার করে,জান্নাত-জাহান্নাম কে অস্বীকার করে।
এখন আপনি কালেমা,সৃষ্টিকর্তা,আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি ঈমান রাখার পরও কেউ যদি আপনাকে বস্তুবাদী বলে অপবাদ দেয়,আপনি কি তা মেনে নিবেন?????
প্রশ্ন রইল আপনাদের কাছে.....
......মুহাম্মদ তাহমিদ রায়হান
Na sir
ReplyDeleteসার আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন কেউ স্রষ্টায় বিশ্বাস করলে আর সে বস্তুবাদী হয়না।
ReplyDeleteসরাসরি নাস্তিক হয়ে বস্তুবাদী হওয়া আর নাস্তিকদের তৈরি বস্তুবাদী মতবাদের ধোকায় পড়ে বস্তুবাদী হওয়া ভিন্ন বিষয়।
মুসলিম দাবি করে আজকে সবাই বস্তুবাদে নিমজ্জিত, আর সেটা নাস্তিক হওয়ার মধ্য দিয়ে হয়, বস্তুবাদী মতবাদের অনুসারী হওয়ার মধ্যদিয়ে।
সুন্দর আলোচনা। বস্তবাদ সাংঘর্ষিক একটা মতবাদ। পরকালে বিশ্বাসী কেউ এই বাদে প্রভাবিত হবে না।
ReplyDelete