বস্তুবাদ কি? পবিত্র কালেমায় বিশ্বাসী কোন মু'মিন কি বস্তুবাদী হতে পারে?
বস্তুবাদ কী???
.... মুহাম্মদ তাহমিদ রায়হান
দর্শনের সবচেয়ে প্রাথমিক মতবাদগুলোর একটি হল বস্তুবাদ। আমাদের চারপাশের জগতের যেসব অস্তিত্ত্ব আমরা পর্যবেক্ষণ করি বস্তুবাদ অনুযায়ী তারা যেকোন প্রকার চেতনা নিরপেক্ষ। যে দার্শনিক ধারায় ধরে নেওয়া হয় যে পৃথিবী বস্তুগত, তার অস্তিত্ব আছে বিষয়গতভাবে, চৈতন্যের বাইরে ও চৈতন্য-নিরপেক্ষভাবে, বস্তুই মুখ্য, তা কারো দ্বারা সৃষ্টি হয়নি এবং আছে বাহ্যিকভাবে, চৈতন্য, চিন্তন হল বস্তুরই একটি গুণধর্ম; পৃথিবী ও তার নিয়মগুলি জ্ঞেয়। বস্তুবাদ ভাববাদের বিরোধী এবং তাদের সংগ্রামই ঐতিহাসিক-দার্শনিক প্রক্রিয়ার আধেয়। বস্তুবাদ কথাটি ১৭শ শতাব্দীতে ব্যবহৃত হয়েছিল প্রধানত বস্তু সম্বন্ধে পদার্থবিদ্যাগত ধারণাগুলির অর্থে এবং ১৮শ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে তা ব্যবহৃত হয়েছে দার্শনিক অর্থে, ভাববাদের বৈপরীত্যে।
নোট ১ // বস্তুবাদীরা মনে করে যে বস্তুই মূখ্য।
নোট ২// বস্তু কারো দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তা বলতে কিছুই নেই।
নোট ৩// মাত্র ২০০ বছর আগে বস্তুবাদ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে।
দর্শন প্রাথমিকভাবে দু’টি বৃহৎ শিবিরে বিভক্ত; ভাববাদ এবং বস্ত্তবাদ। লেনিন লিখেছেন, “ মার্ক্সবাদের দর্শন হ’ল বস্ত্তবাদ”।
দার্শনিক বস্ত্তবাদ সেই দৃষ্টিভঙ্গি যা দিয়ে কেবলমাত্র বস্ত্ত-জগতের কথাই স্বীকার ও ব্যাখ্যা করা হয়। এখানে বস্তু ভিন্ন অন্য কোন পারজাগতিক অস্তিত্ব বস্তুবাদ স্বীকার করে না। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে স্বর্গ ও নরকের কোন স্বীকৃতি থাকে না।(৪) বিশ্বজগৎ সর্বদা-অস্তিত্বশীল একটি বিষয় এবং তা কোন অতি-প্রাকৃতিক সত্ত্বার সৃষ্ট নয়।(৫) এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্যে গতিশীল এক বাস্তবতা।বস্তুবাদ অনুসারে, মানুষ হল প্রকৃতির একটি অংশ এবং নিম্নশ্রেণির জীব থেকে তা বিবর্তিত হয়েছে; যার মূল উৎস ৩.৬ বিলিয়ন বা কাছাকাছি বছর পূর্বে প্রাণহীন বস্ত্তজগৎ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।(৭) প্রাণের বিবর্তনের বিশেষ এক পর্যায়ে প্রাণিদের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের উন্মেষ ঘটে এবং ঘটনাচক্রে বৃহৎ-মস্তিস্ক-সম্পন্ন (অপেক্ষাকৃত বেশী ঘণত্ব সম্পন্ন) মানুষ প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। মানুষের বিবর্তনের সাথে সাথে মানবচিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটে। কেবলমাত্র মানুষের মস্তিস্কের পক্ষেই উন্নত সাধারণ ধারনা সৃষ্টির তথা চেতনা অর্জনের সক্ষমতা আছে। অতএব বস্ত্ত যা চিরকাল কোন না কোন রূপে অস্তিত্বশীল ছিল এবং এখনো তা মানুষ ও জীবজগতের চেতনা-স্বতন্ত্র বা নিররেপক্ষভাবে অস্তিত্বশীল আছে। বস্ত্ত তার সম্পর্কে সচেতনতার উন্মেষের বহুপূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল ছিল, চেতনা বিলুপ্ত হবার পরেও তা থাকবে। এমনকি প্রাণির (মানুষরূপী) মধ্যে চেতন-ক্ষমতার উন্মেষের পূর্বেও বস্ত্তর অস্তিত্ব বর্তমান ছিল।(৮)
নোট ৪// বস্তুবাদীরা পরকাল এবং স্বর্গ-নরক (জান্নাত-জাহান্নাম) এ বিশ্বাসী নয়।
নোট ৫// বিশ্বজগৎ অস্বীত্বশীল অর্থাৎ বিশ্বজগৎ অনাদি অনন্ত এবং তা কোন স্বত্তার (আল্লাহ'র) সৃষ্ট নয়।
নোট ৬// মানুষ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৩.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে প্রানহীন জড়বস্তু থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
বস্ত্তবাদীদের মতে, জীবিত-মস্তিস্ক থেকে বিছিন্ন চেতনার কোন অস্তিত্ব নেই, আর মস্তিস্ক নিজেই বস্ত্তগত দেহের একটি অংশ মাত্র। দেহ ছাড়া মনের অস্তিত্ব একটি অসম্ভব বা অর্থহীন ধারণা মাত্র। বস্ত্ত মন বা চেতনা থেকে তৈরী নয় বা উপজাত নয় বরং চেতনা হ’ল বস্ত্তর সর্বোচ্চ উৎপাদ বা উপজাত বিষয়। ধারণাসমূহ আমাদের চারপাশের স্বাধীন (চেতনা-নিরপেক্ষ) বস্ত্ত-জগতের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়। দর্পনে প্রতিফলিত বস্ত্ত তার অস্তিত্বের জন্য প্রতিফলিত প্রতিবিম্বের উপর নির্ভর করে না। এঙ্গেলসের ভাষায় “ সকল ধারণা অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া, যা বাস্তবতার সঠিক অথবা বিকৃত প্রতিফলন মাত্র।” অথবা মার্ক্সের ভাষায় বলা যায়, “ জীবন চেতনা দিয়ে নির্ধারিত হয় না বরং চেতনাই জীবন দ্বারা নির্ধারিত হয়।”
Comments
Post a Comment